MR-9 মাসুদ রানা সিনেমার শুরুর পেছনের গল্প

MR-9 মাসুদ রানা সিনেমার শুরুর পেছনের গল্প

অনলাইন ডেস্ক :

Asif Akbar – MR-9: Do or Die – হলিউডের সাথে বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর গল্প এবং আসিফ আকবরের আত্মকথন ও কিছু স্মৃতি…

২০১৮ সাল। আমি তখন আমেরিকান একটা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি Avail Entertainment – এর বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেছি। কোম্পানির মালিক পক্ষ জেজে রজার্স ও আসিফ আকবর। বাংলাদেশের প্রতি অপরিসীম মায়া, টান ও ভালোবাসা থেকে আসিফ চেয়েছে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রকে-ও বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা। আমাকে তাঁর এই ভালোলাগা ভালোবাসার কথা সবসময় বলত।

এদিকে আমিও কোম্পানির হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে জড়িত বাংলাদেশে অনেক কোম্পানির পাশাপাশি একদিন জাজ মাল্টিমিডিয়ার অফিসে আজিজ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করি। চলচ্চিত্র ব্যবসা বিষয়ে আমাদের মধ্যে নানান কথাবার্তা হয়। কোম্পানির চলচ্চিত্র বিষয়ক ডিটেইলস বলি। সে বললো জানাবেন। চলে আসি।

পরেরদিন পত্রিকায় দেখি জাজ মাল্টিমিডিয়া ‘মাসুদ রানা’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। নিউজ দেখে এই বিষয়ে আসিফ আকবরের সাথে কথা বলি।
মাসুদ রানা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে শুনে আসিফ একটু নড়েচড়ে বসে। কারণ, আসিফের বয়স যখন ৩-৪ বছর,
আসিফের ছোট চাচা রিপন ভাই আমেরিকার বাসায় ‘মাসুদ রানা’র গল্প পড়ে পড়ে আসিফকে শোনাতেন। গল্প শুনে শুনে ছোটবেলা থেকেই আসিফ ‘মাসুদ রানা’র ফ্যান হয়ে গেছে। সেই স্মৃতিতে হঠাৎ নাড়া লেগেছে।

যাহোক, নিউজ দেখে আসিফের সাথে কথা বলার পর আমাকে বললো- আপনি আজিজ ভাইকে বলেন ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্র হলিউডের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করবে কি-না? আমি তখন নিউ মার্কেট এলাকায়। কল রেখে সাথে সাথে আজিজ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি। আজিজ ভাই সব শুনে ব’লে – ভাই আপনি ৪টায় জাজের অফিসে আসেন। আমি সাড়ে ৩টায় জাজের অফিসের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে বসে নান আর তান্দুরি চিকেন খাচ্ছি, একটু পরেই আজিজ ভাই কল। রিসিভ করতেই- কই আপনি ভাই? অফিসে আসেন আমি আছি। বললাম- কাছাকাছি আছি, আসতেছি ভাই। খাওয়া শেষে জাজে গিয়ে ‘মাসুদ রানা’ বিষয়ে হলিউড ও বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চার বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করলাম। সব শুনে আজিজ ভাই আসিফের সাথে কথা বলতে চায়। জাজে বসেই আসিফকে কল দিয়ে আজিজ ভাইয়ের সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। দীর্ঘ সময় আলাপের পর আজিজ ভাই খুব আনন্দিত মনে হলো। পরেরদিন আজিজ ভাই আমাকে ও নাজিম উদ দৌলা-কে (নাজিম ‘মাসুদ রানা’র স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট করতেছিল) অফিসে ডেকে নিলেন, এবং রাত প্রায় ১২ পর্যন্ত স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলাপ হলো। নাজিমও বিশ্বাস করতে পারছিলো না, কী হ’তে যাচ্ছে। সবার জন্য এতো বড় অপরচুনিটি, উত্তেজনায় ঘুম নাই কারও।

পরেরদিন আজিজ ভাই আমাকে আবার জাজে ডেকে নিলেন। ‘পোড়ামন-২’ সিনেমা নিয়ে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাবেন, বললেন- এই ব্যাপারে আমি কোনো হেল্প করতে পারি কি-না? আসিফের সাথে কথা ব’লে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিলাম। আজিজ ভাই ‘পোড়ামন-২’ নিয়ে কান ফিল্ম ফেস্টে চলে গেলেন। সেখানে আসিফের সাথে মিটিং করে, সব ফাইনাল করলেন। তারপর দেশে ফিরে আসার পর প্রায় প্রতিদিন আজিজ ভাইয়ের বাসায় আমি ও নাজিম সহ ‘মাসুদ রানা’র স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট চলত, ওদিক থেকে আসিফ-ও ভিডিও কলে অংশ নিত। এভাবেই ‘মাসুদ রানা’র বাংলা স্ক্রিপ্ট ডেভেলপ হ’তে প্রায় ১ বছর লেগে গেল।

২০১৯ সালে দফায় দফায় হলিউড থেকে টিম আসা শুরু করলো ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশের শিল্পীদের অডিশন নিবে এবং লোকেশন দেখবে।
সব রেডি, এমন সময় চীনে করোনার প্রভাব বিস্তার শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, সবাই আতংকে! এদিকে MR-9 প্রোজেক্ট নিয়ে সবাই চিন্তিত। আসিফ সবাইকে আস্বস্ত করতো ‘MR-9’ (মাসুদ রানা থেকে ‘MR-9’ রানা’র কোড দিয়ে টাইটেল সিলেক্ট করা হয়েছে) হবেই, একটু অপেক্ষা করেন। এদিকে করোনা মহামারী আকারে রূপ নিয়েছে, সবাই হতাশ! অনেকে ভেবেই নিয়েছে, এই প্রোজেক্ট বোধহয় আর হবে না। কিন্তু, আসিফ হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র না। আমার সাথে প্রায় প্রতিদিন ২/৩ ঘন্টা ওভার ফোনে আলাপ চলত, MR-9 ছাড়াও হলিউড ইন্ডাস্ট্রির নানান গল্প নিয়েও আলাপ, সেখান থেকে ব্যক্তিগত আলাপে গিয়ে ঠেকতাম।

করোনার মধ্যেই হলিউডের ইন্ডাস্ট্রিতে আসিফ ৪টা চলচ্চিত্র প্রোডিউসার হ’য়ে ও ২টা চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ শেষ করে ফেলেছে। হাতে রয়েছে আরও কিছু চলচ্চিত্র। কিন্তু, বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসের রেড জোনে থাকায় ‘MR-9’ নিয়ে আগানো যাচ্ছে না! হলিউড ইন্ডাস্ট্রির নানান এসোসিয়েশন শিল্পী ও কুশলীদের বাংলাদেশে যেতেও দিবে না। যদি কেউ যায় এবং কারও কিছু হয়; সকল দায়-দায়িত্ব আসিফদের নেয়া লাগবে। এতে সবাই একটু ঘাবড়ে গেল! এসোসিয়েশন নানান বাইন্ডিংস দিয়ে বসে থাকায় কেউ রিস্ক নিতে চায় নাই।

ওদিকে আসিফ মেল গিবসন, ফিফটি সেন্ট, মিকি রোর্ক, গ্রেগ ড্যানিয়েল, অমি বিদ্যা সহ বিভিন্ন শিল্পীদের সাথে একটার পর একটা চলচ্চিত্র সায়েন্স ফিকশন, থ্রিলার, হরোর, অ্যাকশন প্রোডিউস ও নির্মাণ করে যাচ্ছে। MR-9 শুরু হ’তে হ’তে প্রায় ২০টা প্রোডাকশন শেষ করে ফেলেছে!

বাংলাদেশে ধীরে ধীরে করোনার প্রভাব কমতে শুরু করেছে, ‘MR-9’ নিয়ে আবার আসিফ জোরেশোরে মুভমেন্ট শুরু করল, এদিকে আমাদেরও দৌঁড়ঝাপ শুরু হ’য়ে গেল।

ফাইনালি ২০২১ সালে ‘MR-9’ এর ক্যামেরা ওপেন হ’য়ে কেমনে কেমনে সিনেমা শেষ-ও হ’য়ে গেল। আর এখন, ২০১৮ সালের প্রস্তুতি নিয়ে ২০২৩ সালের ২৫ আগস্ট MR-9 রিলিজের জন্য প্রস্তুত।

আসিফ একজন বাংলাদেশী বংশদ্ভূত হয়েও হলিউডের মতো একটা ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে কেমনে কতো পরিশ্রম করে আজকে এই অবস্থানে এসেছে, সেই গল্প অনেক নিষ্ঠুর, অনেক চ্যালেঞ্জিং, অনেক ভয়ংকর এবং একেবারে চমকে যাওয়ার মতো। সেই গল্প শুনলে আশ্চর্য না হ’য়ে উপায় নাই। আমি সত্যি অনেক গর্ববোধ করি, আসিফের মতো একজন বাঙালি ছেলে আজকে কোথায় চলে গেছে! 💪🏼

এই হচ্ছে আসিফ আকবর। অসীম ধৈর্য সহকারে কতো ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েও নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করেছে।
আসিফ আকবর, তোমাকে অভিবাদন ও অভিনন্দন!! 🤘🏼👌🏼

গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা না বললেই নয়, আসিফের বাবা এনায়েত আকবর মিলন একজন চলচ্চিত্র প্রেমি। চলচ্চিত্রের প্রতি দূর্বলতা থেকেই পরিবার আত্মীয়স্বজনের বিপক্ষে গিয়ে বড় ছেলেকে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছেন। চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন, এবং ছেলের পাশে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।

পিতা-পুত্র সবসময় চাইতেন, হলিউড ও বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে একটা ব্রিজ তৈরি করবেন। সে যাত্রায় পিতা-পুত্র সফল হয়েছেন। আপনার কাছে ঋণী মিলন ভাই, আমাদের একটা প্রজন্ম খুব সহজে এই ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত করবে।

এখন আমাদের দায়িত্ব এই ব্রিজ যেনো ভেঙে না যায়। ব্রিজ দিয়ে বাংলাদেশের শিল্পী ও কুশলীদের অবাধে যাতায়াত করার জন্য দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। একটা দেশ স্বাধীন ক’রে ফেলেছি, আর একটা ব্রিজ টিকিয়ে রাখতে পারবো না; আমাদের এমন ভাবলে হয় না-কি!!

আরও অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম, এই পোস্টে না; আরেক পোস্টে হবে।

সবাইকে ধন্যবাদ।।

কার্টেসি- চিত্রপরিচালক মিঠু খান এর ফেসবুক ওয়াল থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *