ভৈরবে বেড়েছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট, অতিষ্ঠ সাধারণ ভূমি মালিকরা

ভৈরবে বেড়েছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট, অতিষ্ঠ সাধারণ ভূমি মালিকরা

বার্তাকাল অনলাইন ডেস্ক :

জেলা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখার পর থেকে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বিভিন্ন এলাকায় ও মহল্লায় গড়ে উঠেছে কিছু অদৃশ্য ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। এই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের ভয়াল থাবায় বছরের পর বছর হয়রানি হচ্ছে প্রকৃত জমির মালিকরা।

ভৈরবে ভূমিদস্যুর মাফিয়া সিন্ডিকেটের কৌশল, গতানুগতিকতা ধারার প্রভাবে বিশেষ করে দরিদ্র জমির মালিকদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। এমনই তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন গোপন সূত্রে। এই ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা ভৈরবে দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। মূলত বিগত কয়েক বছর আগে ‘ ভৈরব জেলা’ হবে এমন স্লোগানের পর থেকে ভৈরবে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুধু ভৈরব পৌর শহরে নয় বরং এই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট ছড়িয়ে পড়ে ভৈরবের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে। এই বিষয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিপোর্ট ও অনুসন্ধানে আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। ভৈরবের পৌর শহরের কয়েকটি এলাকা ও মহল্লায় গোপন অনুসন্ধান করে জানা যায়, ভূমিদস্যুরা প্রথাগতভাবে পুরনো খতিয়ান, সিএস (সার্ভে চিহ্ন) এর ভ্রান্তি, দাগে ভুল বা নকশার ঘাটতি, স্থানীয় দলিল সংক্রান্ত অস্পষ্টতা ইত্যাদি খুঁটিনাটি খুঁজে নিয়ে জাল দলিল তৈরি, ভুয়া কেস ফাইল করা বা একপক্ষকে উসকানির মাধ্যমে সংঘাত সৃষ্টি করে জমি দখল করে ফেলছে। আবার একই জমি বাবা-দাদারা বিক্রি করে গেলেও পরবর্তীতে রেকর্ড বা দলিলের করোণিক ভুলের ইস্যু ধরেও ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটদের উৎপাত লক্ষ্য করা গেছে। এতে করে প্রকৃত মালিকদের হয়রানি করার সুযোগ নিচ্ছে ভূমিদস্যু চক্র। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ভৈরবে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটকে একটি লাভজনক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে কিছু কিছু অসাধু ব্যক্তি। বিশেষ করে অসৎ ও ক্রিমিনাল মনমানসিকতার লোকগুলোই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট চক্র তৈরি করছে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভূমিদস্যুদের কাজে স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, স্থানীয় জোরদার লাটিয়াল বংশের কিছু দুষ্ট লোক ও কোর্ট-কাচারির কিছু অসাধু ব্যক্তিরা সাহায্য করছে। ফলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেক সময় দরিদ্র, অনগ্রসর বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তারা আইনি পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদী লড়াই চালিয়ে উঠতে পারেন না; ফলে আদালতের একতরফা রায় বা প্রশাসনিক অনিয়মের সুযোগ নিয়ে দখলদাররা নিজেদের দখলকে বৈধ বলে প্রতিষ্ঠা করে নেয়। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের আন্তঃসমন্বয়ের অভাবও ভুক্তভোগীদের সমস্যা বাড়ায়।

ভূমিদস্যুতার আরেকটি ভয়াবহ কৌশল হল সম্পত্তির প্রকৃতি বদলে দেওয়া—কখনও জনস্বত্বভূমি (ক্যাশ/খাস জমি), কখনও সংরক্ষিত জনজাতিগত জমি বা অনির্ধারিত জলাভাগের জায়গাকে জোরপূর্বক দাবি করা হয়; জাল দলিল, ভুয়া স্বাক্ষ্য বা স্থানীয় শক্তিধরদের হুমকির মারফত আসল মালিকদের উৎপীড়া করা হয়।

ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে ভৈরবে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। পৌরসভা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ও গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও এখন এদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রকৃত ভূমির মালিকেরা নিজেদের বৈধ সম্পত্তি রক্ষায় নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে এসব ভূমিদস্যু চক্রেরর দ্বারা। দেখা যায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও, দীর্ঘসূত্রতা আর দুর্নীতির সুযোগে এ চক্র ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের প্রধান কৌশল হচ্ছে সরকারি রেকর্ডে থাকা দুর্বল দিকগুলোকে কাজে লাগানো। পুরনো সিএস, এসএ, আরএস খতিয়ান কিংবা নকশায় সামান্য ভুল বা অস্পষ্টতা পেলেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এক পক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে বিরোধ তৈরি করে, তারপর সেই বিরোধের সুযোগে দখল বা জাল দলিলের মাধ্যমে জমি আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালায়। অনেক সময় স্থানীয় রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিস কিংবা দখলবাজ মহলের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভূমিদস্যুদের সুবিধা করে দেয়।

এমন বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে প্রকৃত মালিকদেরকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে। কারও জমিতে মিথ্যা মালিকানা দাবি করে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়, আবার কারও জমিতে রাতারাতি বেআইনি স্থাপনা তৈরি করা হয়। যেহেতু ভূমি সংক্রান্ত মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হতে অধিকাংশ সময়ে বহু বছর লেগে যায়, সেই দীর্ঘ সময়ের সুযোগ নিয়ে ভূমিদস্যুরা দখল বজায় রাখে এবং তাতে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে উঠে। বেশ কিছু অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, সিএসের মালিক জমি বিক্রি করেও প্রকৃত ক্রেতা মালিকদের বা তাদের ওয়ারিশদের সেই জমি বুঝিয়ে দেয়নি বরং নিজেরাই দখল করে আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সিএসের মালিক জায়গা বিক্রি করে গিয়েছে বহু বছর আগে, কিন্তু পরবর্তীতে তাদেরই পরের প্রজন্ম সিএসের স্বত্ত্ব মালিকানার ওয়ারিশ দাবি করে প্রকৃত ক্রেতা মালিকের ওয়ারিশদের হয়রানি করছে সিএসের মালিক বলে। ফলে এতে ভুক্তভোগী হচ্ছে জমির প্রকৃত ক্রেতা মালিকগণ। আর এসব অনৈতিক কাজ করতে ইন্ধন যোগায় ভূমিদস্যুদের সিন্ডিকেটগুলো। এছাড়া অনেক সময় জমি বেচাকেনার দালালদের প্ররোচনায় ত্রুটিপূর্ণ জমি কিনেও অনেক ভুক্তভোগী প্রতারিত হচ্ছে। আর সেই সুযোগে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট অর্থের লোভে হয়ে উঠে আরও ভয়ংকর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, রেকর্ড সংরক্ষণের ত্রুটি এবং ভূমি মালিকানার কাগজপত্র শতাধিক বছরের পুরনো হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই সীমানা নির্ধারণে জটিলতা তৈরি হয়। আর এর সুযোগ নেয় সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যু চক্র। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দালাল শ্রেণির লোকেরা মিলে এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যা সাধারণ মানুষ সহজে মোকাবিলা করতে পারে না। এমন কি এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় বিভিন্ন জোরদার বংশের দ্বারা আক্রমন করা হবে এমন হুমকি দিয়েও ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি দেখায় ভূমিদস্যুরা। ভৈরবের ১২টি ওয়ার্ডেই এখন এমন চিত্র প্রায়ই দেখা যায়। ফলে দিন দিন জমিসংক্রান্ত জটিলতা ভৈরবে বেড়েই চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা সংগত কারণে চুপ থাকলেও ভূমিদস্যু চক্র বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে।

বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায়, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, থানায় বা ভূমি অফিসে অভিযোগ দিলে প্রাথমিকভাবে কিছু তৎপরতা দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত মামলাগুলো ধীরগতির কারণে ঝুলে যায়। অনেক সময় ভূমিদস্যুরা মামলার কাগজে প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের পক্ষে সুবিধাজনক তথ্য সংযোজন করিয়ে নেয়। ফলে প্রকৃত মালিককে প্রমাণ দিতে গিয়ে বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে হয়।

তবে অনেক ভুক্তভোগী মনে করেন সরকারের পক্ষ থেকে ভূমি ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ডিজিটাল ও অনলাইন করা হলে অনেকটা হয়রানি কমে আসতে পারে। ভূমি মন্ত্রণালয় “ভূমি তথ্য ব্যাংক” ও “ডিজিটাল খতিয়ান” চালু করেছে, যা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এ ধরনের প্রতারণা অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল করতে না পারে।

সাধারণ মানুষ এখন ন্যায্য সম্পত্তির নিরাপত্তা চায়। ভূমি কাগজের দুর্বলতা নয়, সঠিক প্রশাসনিক পদক্ষেপই হতে পারে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। অন্যথায়, এই সিন্ডিকেটের ভয়ানক ছোবলে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে সাধারণ ভূমির মালিকরা। অশান্তির রাজ্যে ডুবে যেতে পারে প্রিয় শহর কিংবা গ্রাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *